দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেনে একদা

শিলিগুড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল নভেম্বর মাসে। ‘উত্তরবঙ্গ নাট্যজগত্’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী বিপদভঞ্জন সরকারের আমন্ত্রণে ১৭ নভেম্বর বুড়িমাড়ি সীমান্ত পেরিয়ে সস্ত্রীক চেংড়াবন্দা হয়ে শিলিগুড়ি যাই। পরদিন শিলিগুড়ি তথ্যকেন্দ্রে দীনবন্ধু মঞ্চে অনুষ্ঠিত রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুর ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন দু বাংলার জনপ্রিয় কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার। দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা দার্জিলিং-নেপাল-ভুটান ভ্রমণ করি, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে টয়ট্রেনে ওঠা হয় না। আফসোস থেকেই গেল। ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা আমাদের নিমন্ত্রণ করে রাতে বাসায় খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। খাওয়ার সময় আমার স্ত্রী জিনাত রহমান তার আফসোসের কথা বলেন, ‘দার্জিলিং বেড়িয়ে এলাম কিন্তু টয়ট্রেনে চড়তে পারলাম না।’ বিপদ বাবু ও তার স্ত্রী তাত্ক্ষণিকভাবে বিষয়টি গুরুত্ব দেন এবং কথা দেন আগামীকাল আমরা সকলে মিলে টয়ট্রেনে ভ্রমণ করব।

আমরা সকালে শিলিগুড়ি জংশন স্টেশনে সকাল ৯টায় পৌঁছে গেলাম, বিপদ বাবুও সস্ত্রীক পৌঁছালেন। টিকেট কেটে চারজনে বসে পড়লাম ট্রেনে। ছোট্ট ট্রেন খুব মজা লাগছিল। তখন চার বগি বিশিষ্ট গাড়িটিকে একটি ইঞ্জিন হুইসেল মেরে ঝিক ঝিক করে চালু হতেই বিপদ ভঞ্জন সরকার বাবু টয়ট্রেনের ইতিহাস বলা শুরু করলেন। আমরা চুপ করে গালে হাত দিয়ে তার কাছ থেকে যখন কাহিনি শুনছিলাম, তখন আমরাও সেই গাড়ি নির্মাণের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেললাম।

জীবনের পথ বেশ খানিকটা পেরিয়ে না এলে, পিছন ফিরে দেখার দৃষ্টিপথটা একটা নির্দিষ্ট প্রসার না পেলে, নস্টালজিয়া শব্দটার বোধহয় তেমন গুরুত্ব জন্মায় না।

পদমেরও নস্টালজিয়া এসেছে অনেক পরে। পদম অবশ্য খুব ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছে পাহাড় কেটে আশ্চর্য এক রাস্তা তৈরি হওয়ার গল্প, তার বাবা কৃষ্ণ বাহাদুরের কাছে। ওদের ছোট্ট কুঁড়েঘরটাও সেই রাস্তার ধারেই।

বাড়ির সামনে রাস্তা, পিছনে ছবির মতো ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া চাষের জমি। তরতাজা রাইশাকের পাশেই কুয়াশের মাচা। কিছুু কুয়াশ লতা পাশের গাছে উঠে পড়েছে। এক কোণে মুরগির খাঁচা। ছোট্ট এক চিলতে উঠোনে ওরা ভাইবোনে মিলে খেলা করত। কখনোসখনো উঠে আসত রাস্তায়। টগবগিয়ে চলে যাওয়া সাহেব-গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকত অবাক হয়ে। আর সন্ধ্যে হলে বাবার কাছে বসে শুনত সেই রাস্তা তৈরির গল্প।

ওর বাবা কৃষ্ণবাহাদুর এই পথনির্মাণে শ্রমিকের কাজ করেছিলেন। বিপদসঙ্কুল পাহাড়ের গা কেটে কেটে রাস্তা তৈরিতে বিপদ কি আর একটা-দুটো? এই পাথরের বিরাট চাঁই খসে পড়ছে তো এই চিতাবাঘ হানা দিচ্ছে তাঁবুতে। সেইসব গা-ছমছম-করা গল্প শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়ত পদম।

নেপিয়ার সাহেব ছিলেন তত্কালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক লেফটেন্যান্ট। তারই নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে ১৮৬১ সালে তৈরি হয়েছিল শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত বিস্তৃত এই রাজপথ, হিলকার্ট রোড।

তখনও পদমের জন্ম হয়নি। সেটা ১৮৮০ সালের মাঝামাঝি। পদম তখন ষোলো বছরের চটপটে কিশোর। হঠাত্ এক সন্ধ্যায় তার ডাক এল। লোহার লাইন পাতা হবে হিলকার্ট রোডের গা ঘেঁষে। কার্শিয়াং অবধি কাজ শেষ। এবার সোনাদা অবধি পাতা হবে। শেষ পর্যন্ত এ লাইন গিয়ে ঠেকবে দার্জিলিং। উত্তেজনায় টগবগ ফুটতে ফুটতে পদম ছুটল বাবাকে খবরটা দিতে। ছেলের পিঠ চাপড়ে কৃষ্ণবাহাদুর বললেন, ‘ভালোই তো, বাপ রাস্তা বানিয়ে দিল, ছেলে তার ওপর রেখে যাবে তার নিজস্ব শ্রমের লৌহদাগ।’

তখনকার ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে’ কিংবা ‘নর্দার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে’ মোটেই পর্বতসঙ্কুল পথে রেলগাড়ি চালানোর ব্যাপারে উত্সাহী ছিল না। এটা তাদের কাছে নিতান্তই অলাভজনক মনে হয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে অন্তত একজন সেরকম ভাবেননি। বরং ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের এই অ্যাজেন্টটি প্রচুর শ্রমস্বীকার করে এক সুবৃহত্ প্রকল্পের নকশা ও পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন কর্তাব্যক্তিদের সামনে এবং তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এই শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং রেলওয়ে যোগাযোগ অলাভজনক তো নয়ই, বরং প্রভূত অর্থাগম এতে সুনিশ্চিত। সমতল ও পাহাড়ে পণ্যসামগ্রীর বাজারদরের আকাশপাতাল তফাত্ তিনি তথ্যসহকারে দেখান। শিলিগুড়িতে চালের দর যখন টন প্রতি নব্বই টাকা, দার্জিলিংয়ে তখন দুশ আটত্রিশ। স্বভাবতই এই প্রকল্প মঞ্জুরী লাভ করে লে. গভর্নর এডেন দ্বারা ১৮৭৯ সালের ৮ এপ্রিল। রেল ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনাকারী সেই দূরদর্শী পুরুষের নাম ফ্রাঙ্কলিন প্রেস্টেজ।

অনুমোদন মেলার পর একটি মুহূর্তও নষ্ট করেননি এই কর্মী পুরুষ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করে দেন তিনি। বড় সহজ ছিল না এই স্বপ্নসম্ভব যাত্রা। দুই ফুট গেজের লাইনে চেপে সমুদ্রপৃষ্ঠের সাতহাজার ফুট উঁচুতে দার্জিলিং নামের সেই দূরবাসিনীর নাগাল পাওয়ার জন্য যে উজান, তা ছিল বায়ান্ন মাইল দীর্ঘ। কিন্তু প্রেম গভীরতার অতল ছুঁলে কোনো উচ্চতাই কি আর অলঙ্ঘ্য থাকে? বিশেষত আরাধ্যটি যদি হয় পাহাড়-কুয়াশার ছমছম রহস্য মাখা, কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ঠিকরে আসা হিরন্ময় সূর্যালোকদীপ্ত রাজকন্যা! থাকে না, এবং এক্ষেত্রেও থাকেনি। প্রেমিকপ্রবর প্রেস্টেজ সাহেব ১৮৮০ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই শিলিগুড়ি থেকে সুকনা হয়ে তিনধারিয়া পর্যন্ত লাইন পাতার কাজ শেষ করে ফেললেন। এবং মাত্র তেইশে আগস্টের মধ্যেই সে লাইন পৌঁছে গেল কার্শিয়াং। লোকোমোটিভগুলোর বরাত দেওয়া হয়েছিল একই। এবার চারটে স্টিম ইঞ্জিন পৌঁছেও গেল মেসার্স শার্প স্টিওয়ার্ট নামে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কোম্পানিটির কাছ থেকে। এসব সাতকাহন অবশ্য কিছুই জানা নেই পদমের। সে কাজের আনন্দেই মশগুল। অবশ্য সে আনন্দ অবিমিশ্র নয় মোটেই। পাহাড়ি বিপদে তার ভয় নেই। সামনাসামনি পড়লে তার কুকিরীর হাত থেকে নিভৃতচারী চিতারও নিস্তার নেই। তার শুধু খারাপ লাগে সাহেবদের ব্যবহার। তবে সে কাহিনি অন্যত্র।

রেলের লাইন যখন সোনাদা পৌঁছল, কনকনে শীতের সেই হাড়কাঁপানো অনির্বাচনীয় অনুভূতি, ইতিহাস রচনায় সামিল হওয়ার। যদিও ইতিহাস কী? এ ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু ১৮৮১ সালের ফেব্রুয়ারির সেই সূর্যোদয় তার চোখে চিরস্থায়ী এক স্বপ্নদাগ রেখে গেল।

তথ্যসূত্র :দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েজের একশ পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক পত্রিকা।